,

বাংলাদেশে জেনারেলদের ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি

১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্য দৈনিক ‘নতুন দিন’
পত্রিকায় গাফ্ফার চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত
দেওয়ান কাইউম লেখক ও গবেষক, যুক্তরাজ্য।

(দেওয়ান কাইউম একজন নিবেদিত প্রান। যিনি একজন প্রবাসী। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের জাতীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মকান্ডে জাতীয়ভাবে অবদান রেখে যাচ্ছেন। তিনি কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গোয়েন্দাগিরীতে অংশ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতীত হন। তার লিখিত বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ঞযব বসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয, এবহবৎধষং পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হং রহ ইধহমষধফবংয ও মহাকাল বইটিতে অজানা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি যুদ্ধপরাধীদের যারা দেশ বিদেশে লুকিয়ে ছিল, এদের কার্যক্রম ও অবন্তুান বাংলাদেশ সরকারকে জানানো, প্রবাসে গণ আন্দোলন গড়ে তুলা, বঙ্গবন্ধু খুনিদের ট্রাইব্যুনালে বিচারে সাহায্যে তার লেখা একটি দলিল হিসাবে গ্রহণ করা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের খবর অগ্রিম জাতীয় গোয়েন্দাদের সরবরাহ করাসহ বাংলাদেশ বিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের প্রকাশ্যে দাড়িয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। এভাবে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।) বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং শেখ ফজলুল হক মণিকে তার সন্তান সম্ভাব্য স্ত্রীসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট রাতে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের পটভূমি তৈরী হয়েছিল ১৯৭৫ সালের বহু আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই। এর কারন তখনকার সময় মেজর জিয়াউর রহমানসহ কয়েকজন বাঙ্গালী আর্মি অফিসারের উদগ্র ক্ষমতা লিপ্সা এবং সি এই এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তাদের গোপন যোগাযোগ। চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচার করার পরও বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের একজনের দ্বারা বেতারযোগে এই ঘোষনা প্রচারের জন্য মেজর জিয়াউর রহমানকে তারা নিয়ে আসেন। মেজর জিয়া হাতে মাইক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষনা করেন এবং তখনই তার মধ্যে ক্ষমতা দখলের উদগ্র লালসা প্রকাশ পায়। কিš’ু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের তীব্র প্রতিবাদের মূখে তিনি তখনকার মতো সুর বদলাতে বাধ্য হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে কথাটি যোগ করে বেতারে ঘোষনা প্রচারে বাধ্য হন। এখন প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সেই ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত দিনগুলোর শুরুতেই পাকিস্তান আর্মির একজন জুনিয়র বাঙ্গালী অফিসার (মেজর), কাদের ভরসায় এবং কাদের অদৃশ্য সমর্থনের ভরসায় মুক্তিযুদ্ধের গোটা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে অন্তুায়ী সরকারের প্রধান হিসাবে ঘোষনার সাহস পেয়েছিলেন? পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সাবরুম সেক্টরে থাকাকালীন যুদ্ধ পরিচালনার নামে জিয়ার কার্যকলাপ এবং তার দৈনন্দিন যোগাযোগের ইতিহাস দিয়ে এখনও কেউ যদি রিসার্চ শুরু করেন তাহলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার এক অলিখিত অন্ধকার অধ্যায় সকলের সামনে উদ্ঘাটিত হবে। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে গণতান্ত্রিক ধারার বিশ্বাসী যাহারা ছিলেন তারা মেজর জিয়া ও তার সহযোগী কয়েকজন আর্মি অফিসারের কার্যকলাপ এবং মেজর জিয়ার বেতার ঘোষনা নিয়ে তখনই আপত্তি তোলেন। তাজ উদ্দিন সরকার, বিশেষ করে জেনারেল ওসমানী এই সম্পর্কে ব্যবন্তুা করবেন বলে আশ্বাস দেওয়ায় হার্ডকোরের সদস্যরা তখনকার মতো শান্ত হন। কিন্তু এরপর মেজর জিয়াকে মুজিবনগর সরকারের প্রতি তার অবাধ্যতামূলক আচরণের জন্য কোন শাস্তি না দিয়ে সেক্টর কমান্ডারের দায়ীত্ব দেওয়ায় ফজলুল হক মণি সহ তৎকালীন যুবনেতাদের অনেকেই সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। আজকাল যুদ্ধের কোন কোন ইতিহাসে তাজউদ্দিন সরকারের গোপন ও প্রকাশ্যে বিরোধীতার জন্য শেখ মণিকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়। এই বিরোধের সূচনা ব্যক্তিগত প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা থেকে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধ পরিচালনায় কৌশলগত দিক ও শত্রুমিত্র বাছাই নিয়ে। আমার আজ একথা মুক্তকণ্ঠে বলতে দ্বিধা নেই যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সময় তাজউদ্দির সরকার যদি দুর্বলতার পরিচয় না দিতেন, বাহিনীর ভিতরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ বিরোধী, সত্যহীন এবং সিআইএ ও পশ্বিমা গোয়েন্দা সংন্তুাগুলোর সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রক্ষাকারী আর্মি অফিসারদের পার্জিংয়ের ব্যাপারে সিদ্ধাান্ত বারবার পিছিয়ে না যেতেন তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনার পটভূমি এত সহজে তৈরী করা যেতো কিনা সন্দেহের বিষয়। সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত মুজিব নগর সরকারের আস্থা হারিয়ে ফেলার দরুনই শেখ মণি এপ্রিল মাসের শেষ ভাগে শেখ সাহেবের দেওয়া চিরকুট নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাক্ষাত করেন এবং তার সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে ভারত সরকারের সার্চ এনালাইসিস উইং (র’) এর তত্ত্বাবধানে এবং জেনারেল ওবানের পরিচালনায় বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (ইখঋ) বা মুজিব বাহিনী গঠন করা এবং আমি এই বাহিনীর একজন সদস্য ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দিন সরকারের কৌশল ও ব্যবস্থাপনার শুধু শেখ মণি ও তার সহযোগীরাই দ্বিমত পোষন করেননি, টাঙ্গাইলের বাঘা সিদ্দিকী নামের পরিচিত কাদের সিদ্দিকীও সৈয়দ নজরুল তাজ উদ্দিন সরকারের কার্যক্রম এবং মুক্তিবাহিনীর আদর্শ ও আনুগত্যহীন কতিপয় আর্মি অফিসারের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি। তার নেতৃত্বে দেশের অভ্যন্তরে একটি বিরাট মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠিত হয়। এর নাম ছিল কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে সাবরুম সেক্টরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার কাছে জিয়ার বাহিনীর সাথে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়। পরে মুজিবনগর সরকার এই সংঘর্ষ এড়ানোর ব্যবস্থা করেন। তাতে মেজর জিয়া ও বাঘা সিদ্দিকীর মধ্যে মতপার্থক্য ও ব্যক্তিগত রোষ দূর হয়নি। কাদের সিদ্দিকী জিয়া ও তার ভক্তদের মতিগতি তখনই টের পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশে সর্বময় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সেজে আর্বিভূত হচ্ছেন, তখন কাদের সিদ্দিকী দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন এবং আবার জিয়ার চক্রের বিরুদ্ধে অ¯্রধারন করেন। কাদের ছিদ্দিকী অবশ্যই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অ¯্র্রধারন করেছিলেন। কিš’ু তার পিছনে ১৯৭১ সালে জিয়া ও কাদের ছিদ্দিকীর বিরোধ ও সংঘর্ষ যে কারণও কাজ করেছে এবং সেই নেপথ্য কাহিনী এখনো কারও কাছে অজানা নয়। ১৯৭১ সালে আগষ্ট মাসে কাজী জহিরুল কাইউম নামে আওয়ামীলীগের একজন পার্লামেন্ট সদস্য খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে নয়া দিল্লিতে আমেরিকান দূতাবাসে যান। আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির শর্তে পাকিস্তান সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আপোষ ফর্মূলা বের করা যায় কিনা সে সম্পর্কে আলোচনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় খন্দকার মোশতাক (তখন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) নিজেই আমেরিকান দূতাবাসে উপস্থিত হন এবং তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একাংশের সমর্থনে একটি সরকার গঠন করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তিনি বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবটি পুরাপুরি নাকচ করে দেন। আমেরিকান দূতাবাসের নির্দেশে ও সহযোগীতায় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের এই প্রস্তাবটি তৈরী করা হয় বলে জানা যায়। প্রস্তাবটি ইসলামাবাদ পাঠিয়ে আমেরিকান দূতাবাস হয়তো উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বাধ সাধলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তারা অক্টোবর মাসে এই ষড়যন্ত্রের কথা সৈয়দ নজরুল ও তাজ উদ্দিন সাহেবকে হুশিয়ার করে দিল। এই সময় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা খন্দোকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের সমর্থন, পলিটিক্যাল, সিভিল ও মিলিটারী ব্যক্তিবর্গের একটি নামের তালিকা তাজ উদ্দিন সরকারের হাতে দেন। এই তালিকায় মেজর জিয়া এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ট আর্মি অফিসারের নাম ছিল। তাদের একজন পরবর্তীকালে জেনারেল হন এবং আরো পরে কৌটনৈতিক উচ্চপদ থেকে বিতাড়িত হন। এরা খুবই গোপনে এবং নীরবে খন্দোকার মোশতাক আহমেদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। শেখ ফজলুল মণির কাছে এসব তথ্য অজানা ছিলনা। তিনি তাজ উদ্দিন সরকারের কাছে প্রকাশ্যে এসবের ব্যাখ্যা চান এবং জেনারেল (তখন কর্ণেল) ওসমানীর ওপর চাপ প্রয়োগ করেন, যাতে মুজিব বাহিনীর চক্রান্তকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিছুদিন পর জানা গেল কতিপয় নির্দিষ্ট অভিযোগ এবং হাই কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করা ও অবাধ্যতার অভিযোগে জিয়ার কোর্ট মার্শাল করা হবে বলে ওসমানী সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যজনক কারনে জিয়া কোর্ট মার্শাল থেকে বেচে যান। শোনা যায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজ উদ্দিন সাহেব স্বয়ং হস্তক্ষেপ করে জিয়াকে রক্ষা করেন। মুক্তিবাহিনীর অনেকের কাছে খবর পৌছে গেল ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী চাননা মেজর জিয়ার কোন ক্ষতি হোক কিংবা তাকে সেক্টর কমান্ডার পদ থেকে অপসারন করা হক। ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার হঠাৎ এই জিয়া প্রীতির কারণ জানা যায়নি। এই বিষয়টি জানতেন জেনারেল ওসমানী, কিন্তুতখন তিনি তা প্রকাশ করেননি। অনেক পরে প্রেসিডেন্ট পদে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করার সময়ে জিয়া তখন ওসমানীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কুৎসা রটাতে থাকেন। ঠিক তখনই জেনারেল ওসমানী সাহেব বলতে লাগলেন যে, অনেক তথ্য আমাকে বাধ্য হয়ে প্রকাশ করতে হবে। তিনি জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে আমার নির্বাচনী প্রার্থী হওয়ার পেছনে ভারতের হাত আছে বলে তুমি অভিযোগ করছো, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই দূর্যোগময় দিনগুলোতে এবং স্বাধীনতা লাভের পরে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে তোমার সম্পর্কের ভিত্তিটা কি ছিল তা প্রকাশ করতে আমাকে যেন বাধা প্রধান না করা হয়। যাহোক ৭১ সালের মে মাসে জিয়া কোর্ট মার্শাল থেকে বেঁচে গেলেও ওসমানী জিয়ার এক সহচর আর্মি অফিসারকে সেক্টর কমান্ডার পদ থেকে সাসপেন্ড করেন। (আগামী সংখ্যা দেখুন)


     এই বিভাগের আরো খবর